Pages

Sunday, 25 August 2019

তথাকথিত মানবতাবাদীদের লেজ কতো লম্বা?

তথাকথিত মানবতাবাদীদের লেজ কতো লম্বা?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ডিপার্টমেন্টের কোনো নোটিশ আছে কিনা দেখার জন্য ফেসবুকে ঢুকলো আরজু। নোটিশ দেখার পর হঠাৎ সাধ জাগলো তার ফেসবুক ফ্রেন্ডদের প্রোফাইলে ঢুকে Political View দেখবে। যেসব ফ্রেন্ডরা সারাদিন পলিটিক্যাল স্ট্যাটাস দেয়, তাদের অনেকেরই ফেসবুক Political View তে দেওয়া 'I hate politics' এরকম জাতীয় তথ্য।

পলিটিকাল ভিউ'য়ের উপরের অপশনটা Religious View নিয়ে। সেটাতে আবার কয়েকজনের দেওয়া মানবতাবাদ/মানবধর্ম/Humanism প্রভৃতি।
.
ইসলাম, সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট ধর্মের মতো মানবধর্ম ও যে নতুন করে ধর্মের অস্তিত্ব লাভ করেছে সেটা আরজু এতোদিন জানতো না।

আরজুদের ব্যাচের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী কয়েকজনের নাম নিলে নিলয়ের নাম নিতে হয়। সে যখন রাস্তা দিয়ে হাটে, দেখে মনে হয় সে এমনভাবে হাটে যে রাস্তার একটা পিঁপড়া ও তার পদপৃষ্ঠ হওয়া থেকে নিরাপদ। যেমনি মেধাবী তেমনি অমায়িক। আজকাল মেধাবী আর অমায়িক একই সাথে এই দুই গুণের অধিকারী মানুষদের দেখা যায়না, বলা যায় প্রায় বিলুপ্ত। নিলয় হলো বিলুপ্ত প্রজাতির সেই মানুষ।
.
নিলয়ের রিলিজিয়াস ভিউ'তে 'মানবধর্ম' দেখে আরজু অবাক হলো, নিলয়ের মতো একটা মেধাবী ছাত্রের মনে সংশয়ের বীজ বপণ হয়েছে!

ফেসবুক থেকে logout হয়ে আরজু নিচে চা খেতে বের হলো। মোটামুটি ভালোই শীত পড়েছে। সামনে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা, রাতজেগে পড়ার জন্য প্রায় প্রতিরাতে সে বঙ্গবন্ধু হলে গিয়ে চা খায়।

একটা সুয়েটার পরে নিচে নামতেই নিলয়ের সাথে দেখা, নিলয় মুহসিন হলে থাকে। রুটি-ভাজি খেতে নিলয় বঙ্গবন্ধু হলে যাচ্ছে আর আরজু যাচ্ছে চা খেতে। কিছুক্ষণ আগে আরজু চিন্তা করছিলো নিলয়ের সাথে কথা বলবে, খানিকক্ষণ পর এভাবে নিলয়কে পেয়ে যাবে আরজু ভাবতে পারেনি।
.
নিলয় দিলো রুটির অর্ডার আর আরজু দিলো চা'য়ের।
খাবার আসার আগে আরজু নিলয়কে জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা নিলয়, তোর রিলিজিয়াস ভিউ'তে দেখলাম দেওয়া 'মানবধর্ম'। এটা আবার কেমন ধর্ম?"

নিলয় কথা শুরু করার আগে আরজুর দিকে ভালোমতো তাকিয়ে দেখলো। আরজুর মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, মনে হচ্ছে আরজু দাড়ি আর কাটবেনা।

নিলয় বললো, "দেখ পৃথিবীর সব জঞ্জালের মূল এইসব ধর্মগুলো। পৃথিবীতে বড় বড় মারামারি-কাটাকাটি যা হয়েছে তার মূল ঐ ধর্মই। এই পৃথিবীকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে আমাদের পরিচয় একটা হওয়া উচিত, আমরা মানুষ। আর এই মানুষ হিসেবে আমরা যা ভালো তা গ্রহণ করবো, যা মন্দ তা বর্জন করবো। প্রত্যেক মানুষ মানবিক গুণে গুণান্বিত হবে এটাই হলো মানবধর্মের মূল কথা। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ থাকবেনা। কামিনী রায়ের 'পরার্থে' কবিতার মতো, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।

আমরা আজ মানুষ হতে পারিনি বলেই, চারদিকে কেবল অমানবিকতা!"

এই বলে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লো নিলয়।
.
আরজু প্রথমে একটু মুচকি হাসলো। এবার বলা শুরু করলো, "আজ বিকেলে একটা বই পড়ছিলাম। বইয়ের নামটা অদ্ভুত, 'কথা সত্য মতলব খারাপ'। তোর কথা শুনেও এমনটা মনে হলো, তোর কিছু কথা সত্য হলেও মতলবটা আসলে খারাপ!"

নিলয় আড়চোখে আরজুর দিকে তাকিয়ে বললো, "এ্যা! মতলব খারাপ মানে? কি বলতে চাস?"

"না মানে, মানবধর্ম বা মানবতাবাদ নামের আঁচলে নাস্তিকতা লালন এই আর কী! এটা তো আর অস্বীকার করতে পারবি না?"

"দেখ, সে যাইহোক। আমরা তো আর তোদের ধার্মিকদের মতো পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হইনা। কেউ 'জিহাদ' নাম দিয়ে বিধর্মীকে হত্যা করে, কেউবা ক্রুসেড নাম দিয়ে আরেক ধর্মের লোকদের হত্যা করে।
হুমায়ূন আজাদ স্যার 'আমার অবিশ্বাস' বইয়ে ঠিকই বলেছেন, 'নাস্তিক হত্যা করে না; কিন্তু ধার্মিক সব সময় হত্যা ও ধ্বংসের জন্য ব্যগ্র থাকে; তারা ইতিহাসের পাতাকে যুগে যুগে রক্তাক্ত করেছে। প্রত্যেক ধর্মে রয়েছে অসংখ্য সন্ত, যারা ঠাণ্ডা মস্তিস্কের হত্যাকারী'।
.
নিলয়ের মেধা প্রখর, কবে কোন বই পড়েছে, সেই বই থেকে হুবহু রেফারেন্স দিতে পারে সে।

পরক্ষণে আরজু বললো, " Charles Philips এবং Alan Axelord তারা দুজন মিলে একটা বই লিখেন, বইয়ের নাম The Encyclopedia of War বা যুদ্ধের বিশ্বকোষ। বইটিতে তারা মানব ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ১৭৬৩ টি যুদ্ধ গণনা করেছেন। যার মধ্যে মাত্র ১২৩ টি যুদ্ধের কারণ ছিলো ধর্ম। মানে মাত্র ৭%। আর যুদ্ধে নিহত সংখ্যার মধ্যে মাত্র ২ % হলো ধর্মীয় কারণে।[১]

তাহলে দেখ বাকি ৯৩% যুদ্ধ কিংবা ৯৮% যুদ্ধে নিহতের মধ্যে সবই ছিলো ধর্মীয় কারণ বহির্ভূত, অথচ মানবতাবাদী বা নাস্তিক দাবিদাররা সবকিছুতেই ধর্মের দোষ খুঁজে পায়!"

১৩ বছরের একটা ছেলে, নাম কাওসার। সে নিলয়ের জন্য রুটি-ভাজি আর আরজুর জন্য চা দিয়ে গেলো।

ভুল তথ্য উপস্থাপন করে ধরা খেয়ে এবার নিলয় আরো কোনো শক্তিশালী তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করলো। এবার বললো, "দেখ আরজু, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ, সেটাতো আমরা সবাই জানি। তাহলে সবাই এই কমন-কমন জিনিশগুলো মেনে চললেই তো হয়। সেগুলো মানতে গিয়ে ধর্ম আনার কি দরকার? "
.
আরজু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো, "ভালো আর খারাপ একেকজনের কাছে একেকরকম রে নিলয়। কাজ না পাওয়া একটা বেকার যুবকের কাছে চুরি করাটা খুব একটা অন্যায় না হলেও যার জিনিশ সে চুরি করেছে তার কাছে এটা অন্যায়। আবার তুই যে ভালো কাজের কথা বললি সেটার জন্যও একটা স্ট্যান্ডার্ড দরকার।"

নিলয় এবার জিজ্ঞেস করলো, "ভালো কাজের আবার স্ট্যান্ডার্ড কী?"

আরজু বললো, "মা-বাবার সাথে আমাদের ভালো ব্যবহার করা উচিত, তাইনা? কিন্ত কিরকম ভালো ব্যবহার করা উচিত? তোদের মানবধর্মে কি বলা আছে?"

নিলয় বিরক্তমুখে বললো, "ভালো ব্যবহার আবার কিরকম, তাদেরকে কষ্ট না দেওয়া, তাদের সেবাযত্ন করা এই আর কী।"

আরজু আবার প্রশ্ন করলো, "যদি বলি কতটুকু ভালো ব্যবহার, কতটুকু সেবাযত্ন, আর কষ্ট না দেবার মাত্রাটা কিরকম তাহলে কি বলবি?"

নিলয় আবারো বললো, "তুই স্ট্যান্ডার্ড বলতে কি বুঝাতে চাচ্ছিস?"

আরজু হেসে বললো, "মানবতাবাদীদের দৌড় এই পর্যন্ত! সব ধর্মের যে সদুপদেশ আছে তা একত্রিত করে মানবধর্ম/মানবতাবাদ নামে চালিয়ে দেওয়া, কিন্ত স্ট্যান্ডার্ডের কথা বললে তখন আর তারা কিছু বলতে পারেনা। কারণ তখন বলতে গেলে, তাদের কপি করে আনা উপদেশ অবুযায়ীই তো স্ট্যান্ডার্ডটা বলতে হবে। [৩]

এই ক্ষেত্রে দেখ, মা-বাবার সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে সেটা নিয়ে ইসলামে অনেক নিয়ম আছে। তারমধ্য থেকে যদি মাত্র একটা স্ট্যান্ডার্ড বেছে নেই তাহলে মানবতার বুলি আওড়ানো তোদের সবগুলো ভালো কথার চেয়েও ঐটা উত্তম হবে।

এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মা-বাবার সাথে ঠিক সেরকম ব্যবহার করতে যাতে তারা 'উহ' শব্দটা না করে।[২]

এই একটা স্ট্যান্ডার্ড দিয়েই তো মোটামুটি বুঝা যায় তাদের সাথে কিরকম ভালো ব্যবহার করতে হবে, কিরকম সেবাযত্ন করতে হবে আর কিরকম কষ্ট দিতে হবেনা।"
.
আরজুর কথা শুনে এবার নিলয় হাসলো, হাসি থামিয়ে বললো, "এটা অবশ্য ঠিক কিতাবী বিদ্যায় তোদের অনেক ভালোভালো কথা লিখা আছে। কিন্ত বাস্তবে তোরা কতটুকু ভালো ব্যবহার করিছ। যদি সমাজের ভালো কাজের কথা বলিস, তোরা কেউ দান করার আগে চিন্তা করবি যাকে দান করছি সে আমার ধর্মের কিনা, যদি তোর ধর্মের হয় তাহলে দান করবি, যদি তোর ধর্মের না হয় তাহলে দানবাক্সে টাকা দিবিনা।
কিন্ত মানবতাবাদীরা মানুষের ধর্ম।দেখে না, দেখে তাকে মানুষ হিসবে। কিন্ত তোরা ধার্মিকরা ধর্ম দিয়ে মানুষ বিচার করিস!"

নিলয়ের কথা শুনে আরজু আবারো হাসলো।

" বিশ্বখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আর্থুর সি ব্রুকস স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত তার গবেষনাপত্র Religious Faith and Charitable Giving এ তথ্য-উপাত্তসহ এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
রিসার্চ পেপারে তিনি বলেন, Religious people are 25 percentage points more likely than secularists to donate money (91 percent to 66 percent) and 23 points more likely to volunteer time (67 percent to 44 percent).
.
তাছাড়া বিশ্ববিখ্যাত সংবাদপত্র The Telegraph পত্রিকায় John Bingham 'Religion makes people more generous' [৪] শিরোনামে একটি আর্টিকেল লিখেন। আর্টিকেলে তিনি উল্লেখ করেন, বিবিসির গবেষণামতে, ধার্মিক লোকেরা অবিশ্বাসী লোকদের চেয়ে দাতব্য (Charity) কাজে বেশি দান করে।"
.
ততক্ষণে নিলয়ের রুটি খাওয়া শেষ। হাত ধুয়ে এসে নিলয় বললো, "এইসব স্ট্যাটিস্টিক দেখিয়ে কি লাভ বল? যারা লিখছে তারাও তো নিশ্চয় ধার্মিক, তাই ধর্মের স্বপক্ষে লিখছে।"

"তুই তো দেখি এখনো বাচ্চাদের মতো কথা বলছিস! আচ্ছা বলতো, বাংলাদেশে কোন কোন জায়গায় ভিখারীদের সংখ্যা বেশি?"

নিলয় বিদ্রুপের সুরে বললো, "ঐ তো তোদের মসজিদের সামনে, মাজারের সামনে আর হিন্দুদের মন্দিরের সামনে। আর বাকিসব রাস্তার জ্যামে।"

আরজু বললো, "তাহলে দেখ, ভিখারীরাও বুঝে কাদের কাছে গেলে টাকা পাওয়া যায়, অবশ্য তারা কেউই The Telegraph কিংবা আর্থুর সি ব্রুকস এর স্ট্যাটিস্টিক দেখে মসজিদ-মন্দিরে ভিক্ষা করতে যায়নি!"
.
খাওয়ার বিল দিয়ে যাবার সময় আরজু নিলয়ের কাধে হাত রেখে বললো, "স্রেফ মানবতা, মানুষের উপকার করা যদি মানবধর্মের উদ্দেশ্য হতো, তাহলে তুই হলি একজন রোল-মডেল। তোর আচার-ব্যবহার নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্ত এরসাথে যখন স্ট্যান্ডার্ড যোগ হবে তখন সেটা আরো ভালো লাগবে।"

আরজুর কথা শুনে নিলয়ও হাসছে।

তথ্যসূত্র :

১। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড - শামসুল আরেফীন ভাই।
২। সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ২৩।
৩। আদনান ফয়সাল ব্লগ।
৪। http://www.telegraph.co.uk/…/Religion-makes-people-more-gen…


No comments:

Post a Comment

Note: only a member of this blog may post a comment.