মেরাজ বা ঊর্ধ্বগমনের ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক সত্যতা। ১৪০০+ আগের সত্য বিজ্ঞান মেনে নিল।
**********************************
১৪০০ বছর আগে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর আরশ পর্যন্ত ৫ হাজার বছরের পথ মুহূর্তেও মধ্যে ভ্রমণ করে ফিরে আসেন, যা জগতের চিন্তাশীল ও বিজ্ঞানীদের মনের দুয়ার খুলে দিয়েছে। আজ মঙ্গলগ্রহেও বসবাসের চিন্তা করছে মানুষ। যার দূরত্ব পৃথিবী থেকে সাড়ে ৩ কোটি মাইল।
যারা বিজ্ঞানময় কোরআন, পদার্থ বিজ্ঞান, মহাজাগতিক
বিজ্ঞান, আলোক বিজ্ঞান গতি ও সময়ের
সর্বশেষ গবেষণালব্ধ ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকভাবে
জ্ঞান রাখেন, তাদের কাছে মেরাজের সম্পূর্ণ
বিষয়টির সত্যতা দিনের মতো উজ্জ্বল। চোখের
পলকে লাখ-কোটি মাইল পথ অতিক্রম করার ক্ষমতা
আল্লাহপাক ‘বোরাক’কে দিয়েছেন। বোরাকের
নিয়ন্ত্রণকারী স্বয়ং আল্লাহ, তাই চন্দ্র অভিযানে
অ্যাপোলো-১৬-এর ন্যায় তা বিকল হওয়ার নয়।
গতিবিজ্ঞান (উুহধসরপং), মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব (খধি ড়ভ
এৎধারঃু) এবং আপেক্ষিক তত্ত্বের (খধি ড়ভ
জবষধঃরারঃু) সর্বশেষ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার
আলোকে মেরাজের ঘটনাকে বিচার করলে এর
সম্ভাব্যতা সহজেই আমাদের কাছে বোধগম্য
হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে পারেননি যে, মাধ্যাকর্ষণ
শক্তিকে ভেদ করা সম্ভব। যেমন স্যার আইজাক
নিউটনের সূত্র অনুসারে, ‘ষধি ড়ভ সড়ঃরড়হ ধহফ ঃযব
রফবধ ড়ভ ঁহরাবৎংধষ মৎধারঃধঃরড়হ বা মাধ্যাকর্ষণ নীতি
যা ডিঙানো অসম্ভব। কিন্তু সত্তরের দশকের
বিজ্ঞানীরা চাঁদে পৌঁছার মাধ্যমে প্রমাণ
করেছেন যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ডিঙানো
সম্ভব। এ সম্পর্কে আধুনিক বৈজ্ঞানিক অৎঃযবৎ এ
ঈষধৎশ তাঁর ঞযব বীঢ়ষড়ৎধঃরড়হ ড়ভ ংঢ়ধপব
প্রন্থে বলেছেন, ‘Arther G Clark Zuvi The
exploration of space cÖ‡š’ e‡j‡Qb, As the
distance from the earth lengthens in to the
thousand of miles the reduction (of Gravity)
becomes substantial twelve thousand miles up,
an one-pound weight would weight only an one
ounce. It follows, therefore, that further away
one goes from the Earth. The easier it is to go
onwards.
তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘Gravity steadily weakens
as we go up words away from Earth, until at very
great distances it becomes completely
negligible.
রিলেটিভিটি অফ টাইম তথা সময়ের আপেক্ষিকতা
তত্ত্ব
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিক
তত্ত্ব’ (খধি ড়ভ জবষধঃরারঃু) প্রকাশিত হওয়ার পর
মে’রাজসংক্রান্ত এ বিবরণ নিয়ে এখন আর
কোনো প্রশ্ন সাধারণত উত্থাপিত হয় না। বিজ্ঞান
দ্বারা এটি প্রমাণিত। একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে
বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতির এ যুগে
মে’রাজ ও ইসলামের অন্যান্য বহু দিক ও বিভাগ
সম্পর্কে মুসলিম-অসুমলিম নির্বিশেষে সবাই
ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।
আলবার্ট আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি অফ টাইম তথা
সময়ের আপেক্ষিকতার থিওরিটিও মেরাজের ঘটনা
বুঝতে সহায়ক হয়। দ্রুতগতির একজন রকেট
আরোহীর সময়জ্ঞান আর একজন স্থিতিশীল
পৃথিবীবাসীর সময়জ্ঞান এক নয়। রকেট
আরোহীর দুই বছর পৃথিবীর দুশ’ বছরের সমানও
হতে পারে।
পবিত্র কোরআনেও এমন একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
হযরত উযাইর আলাইহিস সালামকে আল্লাহতায়ালা একশ’
বছর ওফাতাবস্থায় রাখলেন। তারপর তাকে জীবিত
করে প্রশ্ন করলেন- ‘বলত, কতদিন এভাবে
ছিলে? তিনি বললেন, একদিন বা একদিনের কিছু সময়
আমি এভাবে ছিলাম। আল্লাহ বললেন, না। তুমি বরং
একশ’ বছর এভাবে ছিলে। তোমার খাবার ও
পানীয়ের দিকে তাকিয়ে দেখ সেগুলো পচে
যায়নি। আর দেখ নিজের গাধাটির দিকে। (বাকারা : ২৫৯)
। এ আয়াতে দেখা যাচ্ছে, হযরত উযাইর আলাইহিস
সালাম যে সময়টাকে একদিন বা তারও কম ভাবছেন
বাস্তবে তা একশ’ বছর। একদিকে তার খাবার পচে
যায়নি তাতে সময়টা সামান্যই মনে হচ্ছে, অপরদিকে
তার মৃত গাধার গলে-পচে যাওয়া বিচূর্ণ হাড্ডি প্রমাণ
করছে বহুকাল এরই মধ্যে চলে গেছে। এটাকে
রিলিটিভিটি অফ টাইম সময়ের আপেক্ষিকতা বলা
যেতে পারে। মার্কিন নভোযান ডিসকভারির
মহাশূন্যচারীরা নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসায়
প্রমাণিত হয়েছে নভোভ্রমণ বাস্তবেই সম্ভব।
কিন্তু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন
মেরাজে গিয়েছিলেন তখন বিষয়টা কল্পনাতীত
ছিল। মিরাজের ঘটনা মহাকাশ বিজ্ঞানের নতুন নতুন
আবিষ্কারের বিশাল অবদান রেখেছে।
বিজ্ঞান বর্ণিত বিশ্ব ও ইলমে মারিফাত
আমরা লক্ষ্য করি, ‘ইলমে মাআরিফাত’ বা আধ্যাত্মিক
জ্ঞানের যে সূত্র দ্বারা মে’রাজকে সহজে
উপস্থাপন করা যায়, তার সঙ্গেও বিজ্ঞানের সূত্রের
কোনো গরমিল নেই। ইলমে মাআরিফাত সমগ্র
সৃষ্টিকে তিনটি ‘আলম’ বা জগতে বিভক্ত করে। এ
তিনটি স্তরের প্রথমটি হচ্ছে ‘আলমে শাহাদাত বা
আলমে খালক’ অর্থাৎ ব্যক্তিজগৎ বা সৃষ্টজগৎ।
দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে ‘আলমে গায়েব’ বা অদৃশ্য
জগৎ। এটি আমাদের স্থূল ইন্দ্রিয় জ্ঞানের অতীত
এক সূক্ষ্ম জগৎ। সৃষ্টির তৃতীয় স্তরটি হচ্ছে
‘আলমে মেসাল’ বা প্রতিরূপ জগৎ। এটিই হচ্ছে
অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি হচ্ছে পূর্ববর্তী
জগৎ দুটোরই অবিকল প্রতিরূপ- ঠিক যেন দর্পণে
প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব। জড় জগৎ ও রূহানী জগতের
জড় ও অজড় সবকিছুই এখানে প্রতিবিম্বিত রূপে
বর্তমানে। এ জগতের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য
হচ্ছে এই যে, এখানে স্থান, কাল ও গতি বলে কিছু
নেই, এখানে সবই বর্তমান, সর্বলোকের। স্থান,
কাল ও গতি এখানে পরস্পরের সঙ্গে মিশে একাকার
হয়ে আছে। বিজ্ঞান বর্ণিত বিশ্বও ইলমে মারিফাত
বর্ণিত বিশ্বের মতোই তিনটি স্তরে বিভক্ত। যথা
জড় জগৎ, অতীন্দ্রিয় জগৎ ও ঋণাত্মক পদার্থ জগৎ
বা প্রতিরূপ জগৎ। কাজেই ইলমে মারিফাত ও
বিজ্ঞানের ধারণা এ ক্ষেত্রে অভিন্ন।
এখন দেখা যাক এ অভিন্ন ধারণার ভিত্তিতে
মেরাজের স্বরূপ ও প্রকৃতি কেমন। এ তত্ত্বের
ভিত্তিতে মে’রাজকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়
যে, মাসজিদে হারাম থেকে মাসজিদে আকসা
পর্যন্ত অর্থাৎ কাবা শরিফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস
পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে
পরিভ্রমণ করেন, তা হচ্ছে জড় জগতে ভ্রমণ।
অতঃপর সেখান থেকে তিনি ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত
যে ভ্রমণ করেন তা হচ্ছে আলমে গায়েব বা
সূক্ষ্মজগৎ পরিভ্রমণ এবং সর্বশেষে আরশে
আযিম পর্যন্ত যে আলাদা জগৎ তিনি পরিভ্রমণ করেন,
তা হচ্ছে আলমে মেসাল বা প্রতিরূপ জগৎ। তিনি এ
জগতে প্রবেশ করেই স্থান-কালের অতীত
অবস্থায় সৃষ্টির সব রহস্য অবগত হন এবং ভূত-বর্তমান
ও ভবিষ্যতের সবকিছু চাক্ষুষ দর্শন করেন এবং
আল্লাহর দিদার লাভ ও তাঁর সঙ্গে কথোপকথন
সম্পন্ন করে পুনরায় জড় জগতে ফিরে আসেন।
ফিরে এসে দেখেন যে, পৃথিবীর সময়ের হিসাব
মোতাবেক অতি সামান্য সময়ই এতে অতিবাহিত
হয়েছে।
সুতরাং বিজ্ঞান মে’রাজকে আরো সহজে বোঝার
ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মেরাজের সময় মহানবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যবহৃত বাহনের
নামটিও এক্ষেত্রে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। এর নাম
হচ্ছে ‘বুরাক’ অর্থাৎ মহাবিদ্যুৎচালিত বাহন, যার গতিবেগ
বিদ্যুৎ বা আলোর গতিবেগের চাইতেও বেশি ছিল।
কিন্তু লক্ষণীয় যে, তা ছিল ‘মহানবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন’।
বর্তমান বিশ্বে নিয়ন্ত্রিত মহাশূন্যযানের কথা সবাই
অবগত আছেন এবং ভবিষ্যতে ‘ফোটনরকেট’ বা
আলোর গতিবেগসম্পন্ন যানের কথাও মানুষ চিন্তা
করছেন। যা হোক, বুরাকের গতিবেগ রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্পূর্ণ
নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল বলে তা কখনো আলোর
গতিবেগের সমান এবং কখনো বা প্রয়োজনের
তাগিদে কমবেশি করা হয়েছিল। কাজেই কাবা শরিফ
থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত তাঁর যে
পরিভ্রমণ ছিল, তাতে সম্ভবত আলোর চাইতে কম
গতিবেগে ‘বুরাক’ পরিচালিত হয়েছিল বিধায় তাতে
‘রাতের কিয়দংশ’ বা সামান্য সময় লেগেছিল, কিন্তু
সেখান থেকে ঊর্ধ্বলোকে তাঁর যে ভ্রমণ, তা
আলোর গতিবেগের সমান বা এর চাইতেও বেশি
ছিল। ফলে এ অংশের ভ্রমণে কাল ছিল স্থবির এবং
পরে পশ্চাৎগামী। বিশেষ করে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’
হতে ‘আলমে মেসাল’ বা প্রতিরূপ জগতে
পরিভ্রমণের সময় ‘বুরাক’ থেকে বেশি
গতিবেগসম্পন্ন ‘রফরফ’ ব্যবহৃত হয়েছিল বলে
সেখানে কাল ছিল পশ্চাৎগামী। ফলে তিনি
সেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে
সম্যক অবহিত হয়েছিলেন ও চাক্ষুষ পরিদর্শন
করেছিলেন। সব মিলিয়ে তাঁর পৃথিবীতে
প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত সময় লেগেছিল অতি সামান্য।
বোরাক ও রফরফ
মেরাজে বাহন হিসেবে বোরাক ব্যবহৃত
হয়েছিল। ‘বোরাক’ আরবি ‘বারকুন’ শব্দ থেকে
উদ্ভূত, যার অর্থ হলো বিদ্যুত (ঊষবপঃৎরপরঃু)। এটা
নূরের তৈরি জান্নাতি বাহন। বিজ্ঞানীদের মতে
আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১,৮৬০০০ (এক
লাখ ছিয়াশি হাজার) মাইল। শাব্দিক অর্থ বিবেচনায়
বোরাকের গতি অন্তত আলোর গতির সমান ছিল।
হয়তো আরও বেশিই ছিল অর্থাৎ এর গতি
অকল্পনীয় দ্রুত। যার কারণেই অতি অল্প সময়ের
ব্যবধানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
সপ্তাকাশ ভ্রমণ সম্ভব হয়েছে।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বোরাকের দ্রুতগতির বর্ণনা দিয়ে বলেছেন,
বোরাক নিজ দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে প্রতিটি
কদম ফেলে। ইট-কংক্রিটের শহরে মানুষের দৃষ্টি
বেশিদূর যায় না ঠিকই, কিন্তু দৃষ্টির সামনে কোনো
অন্তরায় না থাকলে দিগন্ত দেখা যায়। আমরা পৃথিবী
থেকে আকাশও তো দেখতে পাই। সেটা প্রথম
আকাশ, সপ্তম আকাশের আগে কিছু না থাকলে
পৃথিবী থেকেই হয়তো সপ্তম আকাশও দেখা
সম্ভব হতো। এভাবে বিশ্লেষণ করলেই বুঝে
আসে বোরাক কত দ্রুতগতির বাহন ছিল।
বোরাকের গতির প্রকৃত জ্ঞান এখনও হয়তো
মানুষের অর্জনই হয়নি। উপরন্তু মসজিদে আকসা
থেকে ঊর্ধ্বলোকের ভ্রমণের জন্য মে’রাজ
(সিঁড়ি)ও নিয়ে আসা হয়েছিল। বোরাকে চড়ে রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সিঁড়িতে
উঠেছিলেন। ফলে বোরাকের গতি কত বেড়ে
গিয়েছিল তা মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের বক্তব্য হচ্ছে,
আলো অপেক্ষা আলোর তরঙ্গের গতি আরও
অধিক। বোরাক ও মিরাজে ব্যবহৃত সিঁড়ির সমন্বিত গতি
আলো ও আলোর তরঙ্গের গতি থেকেও
বেশি ছিল। কারণ মেরাজের জন্য এ যানটি
বিশেষভাবে পাঠানো হয়েছিল।
আর ‘রফরফ’ হলো বোরাকের চেয়েও
শক্তিশালী, যা মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না।
‘রফরফ’-এর আভিধানিক অর্থ নরম তুলতুলে, সবুজ
বিছানা। সূর্যরশ্মির চেয়েও ক্ষিপ্র তার গতিবেগ।
নবীজীর মে’রাজ সশরীরে হয়েছিল বলেই
‘বোরাক’ ও ‘রফরফ’-এর মতো বাহন ব্যবহৃত
হয়েছিল।
‘বোরাক’ ও ‘রফরফ’ থিওসফি শাস্ত্রের ‘ইথালিক
দেহ’ মানসদেহ অপেক্ষা অধিকতর সূক্ষ্ম,
শক্তিশালী, যুক্তিময়, যা স্থান-কালের মাঝে কোন
সীমা-পরিসীমা ছাড়াই সসীমে মিশে যেতে
পারে। বোরাক ও রফরফ দুটিই বিদ্যুৎ জাতীয়
নূরের বাহন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের দেহ মোবারকও নূরের তৈরি। তাই
আলোর গতির চেয়েও অধিকতর দ্রুতগামী কুদরতি
বাহনে স্বল্প সময়ে মে’রাজ সংঘটিত হওয়া সম্ভব।
অতএব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
মে’রাজ সশরীরে হয়েছিল আজকের
বিজ্ঞানের মহাকাশ বিজয়ই তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বিরুদ্ধবাদীরা বলেন, পৃথিবীর
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি থাকায় শূন্য ভূ-ম-লের যে
কোনো স্থূল বস্তুকে সে নিচের দিকে
টেনে নামায়, তাই কোনো স্থূলদেহী মানুষের
দ্বারা মহাকাশ ভ্রমণ সম্ভব নয়। অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ
শক্তির দোহাই দিয়ে তারা মে’রাজকে অস্বীকার
করেছেন।
বিরুদ্ধবাদীদের সে নীতি আধুনিক বিজ্ঞানীরা
প্রত্যাখ্যান করেছেন। শূন্যে অবস্থিত যে
কোনো স্থূল বস্তুকে পৃথিবী যেসব সময়
সমানভাবে আকর্ষণ করতে পারে না আজ তা
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
তাদের মতে, প্রত্যেক গ্রহেরই নিজস্ব আকর্ষণ
শক্তি রয়েছে। সূর্য ও পৃথিবী একে অন্যকে
টেনে রাখে। এ টানাটানির ফলে উভয়ের মাঝখানে
এমন একটা স্থান আছে, যেখানে কোনো
আকর্ষণ-বিকর্ষণ নেই। যার ফলে পৃথিবীর
কোনো বস্তু যদি সীমানা পার হয়ে সূর্যের
সীমানায় যেতে পারে, তা হলে তা আর
পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। গতিবিজ্ঞানের
মতে, পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুকে প্রতি
সেকেন্ডে ৬.৯০ অর্থাৎ ৭ মাইল বেগে
ঊর্ধ্বলোকে ছুড়ে দেওয়া হলে তা আর
পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। আবার পৃথিবী
থেকে কোনো বস্তু যতই ওপরে উঠবে ততই
তার ওজন কমবে। যার ফলে অগ্রগতি ক্রমেই
সহজ হয়ে যাবে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলেন,
পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুর দূরত্ব যতই
বাড়ে, ততই তার ওজন কমে, পৃথিবীর এক পাউন্ড
ওজনের কোনো বস্তু ১২ হাজার মাইল ঊর্ধ্বে
মাত্র এক আউন্স হয়ে যায়। এ থেকে বলা যায়,
পৃথিবী থেকে যে যত ঊর্ধ্বে গমন করবে,
ততই ততই ওজন কমবে।
বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখেছেন, ঘণ্টায় ২৫
হাজার মাইল বেগে ঊর্ধ্বলোকে ছুটতে পারলে
পৃথিবী থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। একেই মুক্তিগতি
বলে। গতি বিজ্ঞানের এসব নতুন নতুন আবিষ্কারের
ফলে মানুষ চাঁদে যেতে পেরেছে এবং মঙ্গল
গ্রহে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। তাই মাধ্যকর্ষের
যুক্তি দিয়ে মেরাজের সত্য কেউ উড়িয়ে দিতে
পারে না।
জড়দেহের নভোলোকে গমন
বিরুদ্ধবাদীদের মতে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লামের দেহ জড়দেহ, তাই তা নভোলোকে
পৌঁছতে পারেন না। মূলত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম মানব ছিলেন বলে আমাদের মতো জড়
উপাদান বিশিষ্ট মানব ছিলেন না। আল্লাহর সৃষ্টিজগতে
দেখা যায়, বুনিয়াদ এক হলেও প্রতিটি বস্তুরই ভিন্ন
ভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন কয়লা থেকে
হীরক প্রস্তুত হয়। উভয়ই পদার্থ। কিন্তু তাই বলে
এ দুইটি পদার্থ এক নয়। তা ছাড়া সব পদার্থের
সবখানেই ধর্ম এক নয়। যেমন কাচ জড় পদার্থ, বাধা
দেওয়া তার ধর্ম। এ জন্য একটা কাঠ তার মধ্য দিয়ে
যেতে পারে না; কিন্তু আলোক রশ্মি তার বুকের
ভেতর ভেদ করে চলে যায়, বাধা দিতে পারে না।
আবার দেখা যায়, পানির কঠিন, তরল ও বায়বীয় তিন
অবস্থায় ভিন্ন-ভিন্ন তিনটি রূপ, একটি থেকে অন্যটি
ভিন্ন। এমন অনেক অস্বচ্ছ পদার্থ রয়েছে যার
ভেতরে সাধারণ আলো প্রবেশ করতে পারে না,
কিন্তু রঞ্জন রশ্মি বা এক্সরে তা ভেদ করে চলে
যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, আমরা যে পদার্থ দেখি
তা-ই যে তার একমাত্র সত্য রূপ, এ কথা নিশ্চিত করে
বলা যায় না।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে
জড়দেহী মানুষ বেশে দেখা গেলেও
প্রকৃতপক্ষে তিনি জড়ধর্মী ছিলেন না। তিনি
জ্যোতি বা নূর দিয়ে সৃষ্ট। নূরের কোনো ওজন
নেই। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের
দেহ নূরের তৈরি, তাই তার পক্ষে মহাকাশ ভ্রমণ
সম্ভব হয়েছে।
অল্প সময়ের মধ্যে গমন ও প্রত্যাবর্তন
সন্দেহবাদীদের ধারণা, এত অল্প সময়ের মধ্যে
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইতুল মোকাদ্দাস
হয়ে সপ্তম আসমানের ওপর সিদরাতুল মুন্তাহা
পেরিয়ে আল্লাহর সঙ্গে কথাবার্তা বলে আবার
মক্কায় ফিরে এলেন, তা কি করে সম্ভব!
মূলত আল্লাহর সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর সময়ের
মিল হবে না। বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের ঘড়ি
অন্য গ্রহে অচল। এ বিষয়ে আধুনিক
বিজ্ঞানীদের মত, স্বভাবের প্রকৃত সময়
সম্পর্কে আজো আমরা জানি না। বিজ্ঞানীরা জানান,
আলোর গতির যত কাছে যাওয়া যায়, ততই সময় শ্লথ
হয়ে আসে। আলোর গতি অপেক্ষা বেশি
দ্রুতগতিতে গেলে সময় উল্টো দিকে বয়।
মেরাজের বেলায়ও তা হয়েছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাহনের গতি আলোর গতি
অপেক্ষা বেশি ছিল; তাই মে’রাজ থেকে ফিরে
এসে বিছানা উষ্ণ পাওয়ার বিষয়টিও সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভাষায় ‘ঞযবৎব রং
হড় ংঃধহফধৎফ ঃরসব, ধষষ ঃরসব রং ষড়পধষ’ স্ট্যান্ডার্ড
টাইম বলে কোনো টাইম নেই, সব টাইমই
লোকাল অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে প্রযোজ্য।
আল্লাহর কাছে স্থান, কাল, গতি ও সময়ের
কোনো বন্ধন নেই। তিনি যখন যা ইচ্ছা করেন
মুহূর্তের মধ্যেই তা ঘটিয়ে থাকেন। তার রহস্য
সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান অক্ষম।
রাসুলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বক্ষ বিদারণ
ও মহাশূন্যচারীর দৈহিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ
মে’রাজ বা ঊর্ধ্বলোক পরিভ্রমণের পূর্ব মুহূর্তে
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্ষ
বিদারণের বিষয়টিও এখানে লক্ষণীয়। আমরা জানি,
সার্জিক্যাল অপারেশনের ক্ষেত্রে হৃৎপি-কে
বক্ষবিদারণের মাধ্যমে দেহের বাইরে এনে
প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার যথাস্থানে
প্রতিস্থাপন করা বর্তমান যুগে কঠিন কিছু নয়। তা ছাড়া
আজকাল ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র কয়েক শ’ মাইল
দূরত্বের মধ্যে এবং প্রতি সেকেন্ডে মাত্র সাত
মাইলের মতো গতিবেগে পরিভ্রমণের জন্য
যেসব মহাশূন্যচারীকে কক্ষপথে পাঠানো
হচ্ছে, তাদেরও বহু সময়ব্যাপী বহুবিধ দৈহিক ও
মানসিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এমনভাবে প্রস্তুত
করে নেয়া হয়, যাতে তারা অপার্থিব পরিবেশ-
পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের খাপ
খাইয়ে নিতে পারে। জড় জগতের এ সীমিত পরিসর
ও সামান্য গতিবেগে পরিভ্রমণকারীকেই যদি
এভাবে প্রস্তুত করে নিতে হয়, তাহলে স্থান-
কালের অতীত ঊর্ধ্বলোকে প্রতি
সেকেন্ডে এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল বা এর
চেয়েও অধিক গতিবেগে পরিভ্রমণকারীর জন্য
সেরূপ পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন অবশ্যই আছে
এবং ওই ভ্রমণে যেসব অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করবেন
সেগুলো পরিপূর্ণভাবে আত্মস্থ করার লক্ষ্যে
বক্ষবিদারণের মাধ্যমে তাঁর কালবকে ‘বিশ্বাস ও
হিকমত’ অনুপ্রবিষ্ট করার মাধ্যমে শক্তিশালী করা
নিশ্চয়ই জরুরি ছিল।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক বায়তুল
মোকাদ্দাস দর্শন ও বিবরণ প্রদান
মে’রাজ সম্পর্কিত যে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি সম্পর্কে
খানিকটা আলোচনা করতে চাই তা হচ্ছে
প্রত্যাবর্তনের পর কাবা প্রাঙ্গণে অবস্থান করে
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক বায়তুল
মোকাদ্দাস দর্শন ও লোকজনের সামনে এর
বিবরণ প্রদান। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
যখন মেরাজের বিবরণ লোকজনের সামনে
প্রদান করছিলেন তখন মক্কার অবিশ্বাসী কুরাইশ
নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে আবু জাহল রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মিথ্যাবাদী ও পাগল
প্রতিপন্ন করার জন্য তাঁর কাছে চূড়ান্তভাবে বায়তুল
মোকাদ্দাসের যথাযথ বর্ণনা দাবি করে। ঠিক তখনই
আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হযরত জিব্রাইল আলাইহিস
সালাম স্বীয় পাখার ওপর বায়তুল মোকাদ্দাসসহ
রাসুলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনে
উপস্থিত হন অথবা তাঁর ও বায়তুল মোকাদ্দসের
মধ্যকার পর্দা উঠিয়ে নেয়া হয়। প্রিয়নবী হযরত
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দেখে
দেখে সবার সামনে তা উপস্থাপন করেন। আজকাল
টেলিভিশনের পর্দায় যে কোনো দূরের
বস্তুকে চাক্ষুষ দর্শনীয় করে তোলা
বিজ্ঞানের কল্যাণে খুব সহজ ব্যাপারে পরিণত
হয়েছে। কাজেই মহান আল্লাহও যদি এ ধরনের
কোনো পদ্ধতিতে দূরবর্তী বায়তুল
মোকাদ্দাসের প্রতিচ্ছবি হযরত জিব্রাইলের
আলাইহিস সালাম মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের সামনে উপস্থাপন করেন, তাতে
আশ্চর্যের কী আছে? বরং আধুনিক বিজ্ঞান
বিষয়টিকে সহজে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।
আল্লাহতাআলার নূরকে সচক্ষে দর্শন
সর্বশেষ একটি কথা বলা জরুরি, তা হচ্ছে, মহান
আল্লাহতাআলার নূরকে সচক্ষে তথা চর্মচক্ষে
দেখা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। হযরত মুসা আলাইহিস
সালামের মতো একজন বিশিষ্ট পয়গম্বরও তা
পারেননি, বরং আল্লাহর নূর দর্শনে তিনি অজ্ঞান
হয়ে পড়েন। অথচ কী আশ্চর্য, মহানবীকে
স্বয়ং প্রভু তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে পাঠালেন,
আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন
এবং তাঁর দিদার লাভে ধন্য হলেন। আল্লাহকে চাক্ষুষ
দর্শনের পরও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আর এ
ক্ষমতা স্বয়ং আল্লাহপাকই তাঁকে দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে তিনিই সম্পূর্ণ সফল এবং এটাই তাঁর
শ্রেষ্ঠত্বর বড় প্রমাণ।
উপসংহার
প্রকৃত পক্ষে মানুষের কাছে যা অসাধারণ বা অসাধ্য
আল্লাহর কুদরতের কাছে তা একেবারেই সাধারণ,
সম্ভব। মিরাজের গোটা ঘটনাটিই মানুষের কাছে
বিস্ময়কর হলেও বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের
মাধ্যমে তার যথাযত প্রমাণিত হয়েছে। কিয়ামত অবধি
তা আরও স্পষ্ট হতে থাকবে। মে’রাজ
বিজ্ঞানীদের চিন্তা ও গবেষণার দিগন্ত উন্মোচন
করেছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতি মেরাজের
সত্যতাকেই বারবার প্রমাণ করেছে। ভবিষ্যতে
আরও করতে থাকবে। মে’রাজকে কেন্দ্র
করে গবেষণা অব্যাহত রাখলে বিজ্ঞানীরা আরও
বহুদূর এগিয়ে যাবেন নিঃসন্দেহে। তাতে
ঈমানদারদের ঈমান-বিশ্বাস আরও সুদৃঢ় হবে।
প্রত্যেক নবী-রাসূলের জীবনেই কিছু না কিছু
মুজিজা বা অলৌকিক ঘটনা থাকে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিজাসমূহের
মধ্যে মেরাজ অন্যতম। এটি এমনই এক ঘটনা, যার
সাথে রয়েছে ঈমানের গভীরতম সম্পর্ক।
কাজেই মেরাজের বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজতে যাওয়াও
বলা বাহুল্য, যুক্তি কোনো দিনই ঈমানের ভিত্তি নয়,
ঈমানই হচ্ছে যুক্তির ভিত্তি। বরং যুক্তির মত যেখানে
শেষ ঈমানের যাত্রা সেখান থেকেই শুরু। তার
পরও কোনো কোনো মহৎ ব্যক্তি এ ব্যাপারে
যুক্তির অবতারণা করে থাকেন, সেটা শুধু ঈমানের
স্বাদ অনুভব করার জন্যই। বিজ্ঞানের এ চরম
উৎকর্ষের যুগে আমরাও তাই মেরাজকে
বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পাই

No comments:
Post a Comment
Note: only a member of this blog may post a comment.